বুদ্ধের বয়স তখন আশি বছর। তিনি জ্ঞাত হলেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। শিষ্য আনন্দকে ডেকে তিনি ধর্ম বিষয়ে শেষ উপদেশ দিলেন। বয়সের ভারে বুদ্ধের শরীরের বল কমে গেল। এ গ্রাম ও গ্রাম। এ শহর ও শহর ঘুরতে তাঁর খুব কষ্ট হতে লাগলো। তারপরও জ্ঞান বোধিতে তিনি যা পেয়েছিলেন তা-ই সকলকে বোঝাতে লাগলেন। এক কামারের বাড়িতে খেলেন ‘সুকুর মদ্দর’; কেউ বলেন এটা হল ‘ব্যাঙের ছাতা’, আবার কেউ বলে ‘কচি শুয়োরের মাংস’। খাবার পর তাঁর খুব পেটে ব্যাথা হল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বুড়ো বয়সে অসুস্থ শরীরে তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। তখন তিনি আনন্দকে বললেন, দুটি শালগাছের মাঝের ফাঁকে চাদর বিছিয়ে দিতে। তাঁর জন্মও হয়েছিল ‘লুম্বিনী’তে দুই শালগাছের মধ্যে। আনন্দ তখন বুদ্ধকে যত্ন করে শুইয়ে রেখে খুব কাঁদলেন। বুদ্ধ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালেন, সমস্ত প্রাণীকেই একদিন মরতে হয়। এ নিয়ে পরিতাপ করা কি ঠিক? বুদ্ধ আনন্দকে বললেন, সমস্ত শিষ্যদের প্রতি তাঁর কিছু বলার কথা আছে। তারপর দলে দলে শিষ্যরা এসে দাঁড়াল। বুদ্ধ তাঁদের বললেন - ‘ধর্ম’, ‘সঙ্ঘ’ ও ‘বুদ্ধ’কে মনে রেখে তাঁরা যেন নিজেদের জীবন চালায়, মন থেকে সব রকমের লোভকে সরিয়ে দেয়। খানিক পরে ধীরে ধীরে তাঁর নিঃশ্বাস থেমে গেল। সেদিন ছিল ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’। শিষ্যরা গভীরভাবে শোকে ডুবে রইল। তারা খুব ঘটা করে মৃতদেহের সৎকার করল। ‘দ্রোণ’ নামে তাঁর এক শিষ্য বললেন, গৌতম বুদ্ধের ইচ্ছা, তাঁর দেহ যেন পূজার জন্যে ব্যবহার না করা হয়। তাই তাঁর দেহের অবশেষের কিছু কিছু নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ‘আটটি স্তূপ’ করা হল। তখনকার ধর্মীয় আচার ছিল বহু পশু বধ করে মহা ধুমধাম করে যাগযজ্ঞ করা; যদিও সেটা বুদ্ধ মানেন নি। আর এক রকমের ধর্মীয় আচার ছিল, শরীরকে কষ্ট দিয়ে উপবাস করা। না ঘুমিয়ে, নানা কষ্টকর অবস্থায় বসে দাঁড়িয়ে ধ্যান করে যাওয়া; এ-ও বুদ্ধ মানেন নি। অতিরিক্ত ভোগ সুখের জীবনকে তিনি বারণ করেছিলেন। আবার বাড়াবাড়ি রকম কষ্টকর সাধনাতেও তাঁর সায় ছিল না। তাঁর মতে চারটি আর্য সত্য ছিল - ‘মৈত্রী’ অর্থাৎ সকল জীবনকে ভালোবাসা, ‘করুণা’ অর্থাৎ সকল জীবের প্রতি দয়া, ‘মুদিতা’ অর্থাৎ সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি ও ‘উপেক্ষা’ অর্থাৎ মনটাকে শান্ত, অবিচল রাখা। সংসারে নানারকম দুঃখ আছে, সে সব দুঃখের কারণও রয়েছে। আবার দুঃখকে বিনাশও করা যায়। উপায় হল, মন থেকে সমস্ত বাসনা ঝেড়ে ফেলা, লোভকে উপড়ে ফেলা। বুদ্ধকে প্রায়ই লোকেরা 'ঈশ্বর' ‘ভগবান’, ‘আত্মা’, ‘পরলোক’ এ’সব নিয়ে প্রশ্ন করত। যদিও বুদ্ধ কখনোই এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বরং চুপ করে থাকতেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে এই জীবনের চোখের সামনে মানুষের এত দুঃখকষ্ট যখন দেখা যাচ্ছে, তখন সেগুলো দূর করাই তো আসল কাজ; ওই সব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকারই বা কী? বুদ্ধের কাছ থেকে এই পৃথিবী নতুন যা পেল তা হল, জীবন মাত্রই ভালোবাসতে হবে। ‘জাতপাত’ তিনি একেবারেই মানতেন না। যে ‘আম্রপালী’ অশুচি জীবন যাপন করত সেও শিষ্য, যখন সে পুরনো জীবন থেকে ফিরে নতুন জীবনের দিকে ঘুরল তখন বুদ্ধের দয়া পেল, দীক্ষা নিয়ে তাঁর ভক্ত হল। খুনেডাকাত ‘অঙ্গুলিমাল’ও অন্যায় পথ ছেড়ে এসে বুদ্ধের শিষ্য হল। কামারের ঘরে মাংসও তিনি খেতে পারেন। জাতিভেদ তখনকার সমাজের মস্ত বড়ো এক অভিশাপ ছিল, তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করলেন বুদ্ধ। তিনি স্পষ্ট করে বললেন, ‘জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ বা চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই হয়’। ধনীরা বহু পশু হত্যা করে নানা ‘যজ্ঞ’ করত; বুদ্ধ বললেন - ‘ওতে ধর্ম নেই’। ‘সকল প্রাণীকে ভালোবাসার মধ্যেই আছে আসল ধর্ম’। বুদ্ধের শাস্ত্র বলে - ‘‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায়, লোকানুকম্পায়ৈ, মহতো জনকায়স্যার্থায়।।’’ অর্থাৎ, ‘‘বহু মানুষের মঙ্গলে, বহু মানুষের সুখের জন্য, প্রাণীদের প্রতি মমতার বশে, বৃহৎ মানবজাতির কল্যাণে।’’ মানুষের ধর্ম যদি মানবিকতা হয়, এর চেয়ে বড়ো করে ধর্মকে কেউ কখনো ভাবেনি, এর চেয়ে উঁচু করে ধর্মকে কেউ কখনো দেখেনি; বুদ্ধের আগেও নয়, বুদ্ধের পরেও নয়। ©রাজিক হাসান
Mtv channel
0
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন